কবি শঙ্খ ঘোষের জীবনাবসানে বাংলা সাহিত্যের জগতে ইন্দ্রপতন ঘটল। যথেষ্ট পরিণত বয়সে তার জীবন স্তদ্ধ হল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি অসুস্থ এবং দ্রুত কর্মক্ষমতা হারাচ্ছিলেন, মৃত্যু ক্রমশই তার ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের দুয়ারে উকিঝুঁকি মারছিল হয়তো বা, কিন্তু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যের অগণিত পাঠকপাঠিকা শুধু নয়, অতি কাছের প্রিয়জন ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকরাও সেই পদধ্বনি অস্বীকার করছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক সময়ে প্রায় প্রতিদিন কলকাতা শহর ও সংল এলাকার নানা অনুষ্ঠানে ‘না বলার শর্তে’ ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সাধারণ কোনো অনুষ্ঠানেও তরুণ প্রজন্মের কোনো কবি লেখকদের আমন্ত্রণে তিনি যেতেন এবং দীর্ঘ সময় নীরবে নিঃশব্দে বসে অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করতেন। প্রবল অস্থিরতা, নিজের অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কারও অনুষ্ঠান চরম অবহেলা ও তাচ্ছিল্য ভরে উপেক্ষা করার প্রবণতার দিনগুলিতে, কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন অন্যতম ব্যতিক্রম। বাংলার সংস্কৃতিজগৎ তাঁর সৌজন্য ও শিষ্টাচার থেকে বঞ্চিত হবে শুধু নয়, এমন দুর্লভ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বর সন্ধান আর কোনো দিন মিলবে কিনা সন্দেহ।

শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্র-উত্তর সময়ের বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে মেধাবী ও সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তিনি কবি, ছান্দসিক, গবেষক প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনের ধ্যান ও আশ্রয়। কবি শঙ্খ ঘোষ নামে পরিচিত হলেও তাঁর গদ্যসাহিত্যসম্ভার যেমন পরিমাণে বিপুল, তেমনই সাহিত্যসংস্কৃতির নানা অঙ্গনে তাঁর ছিল অনন্য বিচরণ। তিনি ছিলেন সহৃদয় শিক্ষক, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধার ‘স্যার’ এবং তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। তার প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রায় এক দশক আগে (ফেব্রুয়ারি ২০১২) লিখেছিলেন: আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বললেও, শঙ্খ ঘোষ সারা বাংলার রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর পর তরুণ কবিরা প্রেরণার জন্য বারবার তার কাছেই ছুটে গেছে। আমি তাঁর কবিতার ভত্ত্ব, তার ব্যক্তিত্বের ভক্ত, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ অলিখিত নেতৃত্বের ভক্ত। এসব কথা আগে কখনও লিখে জানানো হয়নি, এখন আর দেরি করতে চাই না।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরই প্রয়াত হয়েছিলেন। চমৎকারভাবে সোজাসাপটা শঙ্খ ঘোষের মূল চরিত্র তুলে ধরেছিলেন সুনীল। রবীন্দ্রনাথ তরুণ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে ন্যূনতম প্রতিভার স্বাক্ষর দেখলেও অভাবনীয় দরদি মন নিয়ে নবাগতদের স্বাগত জানাতেন৷ বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য কবি সাহিত্যিক তার স্নেহ ও প্রশ্রয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন তা এখন সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রই জানেন।

আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধানপুরুষ বুদ্ধদেব বসুর কবিতাপ্রেম ও নতুন সম্ভাবনাময় কবিদের কবিতার পাণ্ডুলিপি সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্গঠন এখন প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কবিতা এবং প্রগতি পত্রিকা কেন্দ্র করে কবিগোষ্ঠী গড়ে ওঠা এবং তার বাসভবন কেন্দ্র করে কবিতার তুমুল চর্চা একালের সব কবিই নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। বুদ্ধদেবের নিজস্ব প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়লেও তা অনুভব করা যায়। কবি জীবনানন্দকে যে-ভাবে তিনি পাঠকসমাজের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তা অবিস্মরণীয়। তরুণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘ এক বিশ্লেষণমূলক সমালোচনা প্রবন্ধে যে সাহসের সঙ্গে তিনি প্রকাশ করেছিলেন তা কবিতার প্রকৃত জহুরি ও তরুণের স্বপ্নসাথি হওয়া ছাড়া সম্ভব ছিল না। ইতিহাস এখন স্পষ্ট, তিনি কতটা নির্ভুল ও নির্মোহ ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেবদের ঐতিহ্য কবি শঙ্খ ঘোষের মনন ও মেধার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছিল। কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের সকল কবি সাহিত্যিক ও ছোটোপত্রিকার সম্পাদক এবং সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে ছড়িয়ে থাকা নবাগতদের অতি প্রিয়জন এবং আসল। তার নিজ বাসভবনে রবিবারে সকালের আড্ডা ছিল বর্ণময়। চেনা-অচেনা ভেদাভেদ ছিল না, কে বড়ো কবি বা লেখক তারও বাছবিচার ছিল না। সকলের জন্য দ্বার ছিল উন্মুক্ত। মিতবাক কবি শঙ্খ ঘোষ কোলাহল পছন্দ করতেন না, তাঁর বাঝাল কণ্ঠঙ্গর কখনও তিনি ব্যবহার করেননি, কিন্তু তার বাড়ির উপছেপড়া ভিড় ছিল তার অন্যতম প্রিয় উজ্জীবন। মিতবাক কবি সামান্য দুচারটি কথা হয়তো কখনও বলতেন, কখনও বা থাকতেন সম্পূর্ণ মৌন, বুকে কবি বন্ধুরা আলোচনা ও তর্কবিতর্কে মেতে উঠতেন অবিরল ধারায় তারই প্রশ্রয়ে।

সমসাময়িক রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সর্বত্র সেই তর্কবিতর্ক প্রসারিত হতে পারত তাঁরই প্রশ্রয়ে। বিনয় ও নম্রতার প্রতীকচরিত্র হলেও নানা সময়ে তার যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদ ছিল তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। তাঁর কবিতা ক্রমশই সমসাময়িক পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ থেকে সরতে সরতে অনেক দূর সরে এসেছিলেন তিনি। সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন এবং গণহত্যার ঘটনাবলি নিদারুণ প্রভাব ফেলেছিল তার সৃজনে মননে। সমাজচেতনার প্রতিফলন তাঁর কবিতায় ক্রমশই উজ্জ্বলতর হতে থাকে। সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনেও তাঁকে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল। আনন্দবাজার পত্রিকার কর্মীদের ধর্মঘটের সমর্থনে পথে নেমে এসেছিলেন তিনি যার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল নানাভাবে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় তার মেধা ও মনন দিয়ে যেমন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন, তেমনি কোনো সংশয় ও দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে সমালোচনায় মুখর হতেও দ্বিধা করেননি। ১৯৯০ সালেই বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থান জরুরি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেও বেশ কিছু ত্রুটি সংশোধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ষড়যন্ত্র আন্দোলন পর্বে লিখেছিলেন ‘সবিনয় নিবেদন’-এর মতো ক্ষুরধার সমালোচনায় মুখর কবিতা। তারই আহ্বানে পথে নেমে এসেছিলেন তার অনুগত এবং নন্দীগ্রাম ষড়যন্ত্র আন্দোলনের সমর্থক একদল বুদ্ধিজীবী। নির্বাক কবি কলকাতা মহানগরীর রাজপথ মুখরিত করে তুলেছিলেন নীরব প্রতিবাদে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেকে বাংলা সাহিত্যে তার অসাধারণ অলিখিত নেতৃত্বের ভক্ত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এই স্বীকৃতি ছিল খুবই যথার্থ এবং সঠিক। তাঁর মতো একজন সাহিত্যিক এই স্বীকৃতি দিয়ে নিজের সম্মানই বৃদ্ধি করেছিলেন। অসাধারণ অলিখিত নেতৃত্ব’ সহজে অর্জন করা যায় না। কোনো সংগঠন বা সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান এই নেতৃত্বর স্বীকৃতি দেয় না। প্রজন্মের পর প্রজন্মে একজন লেখকের অবদান ও অবস্থানের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের মধ্যবর্তিতায় এই স্বীকৃতি মান্যতা পায়। শঙ্খ ঘোষ একজন জনপ্রিয় পরিশ্রমী শিক্ষক ও গবেষক। ছাত্রছাত্রীদের সহায়তাদানে তাঁর তুলনাহীন আগ্রহ, কত কবির কবিতা সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেছেন তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই, বৈঠকি আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহচার্য দিয়েছেন, তবু তার সৃষ্টির পরিমাণ বিপুল।

কবি খ্যাতিই তাঁর পরিচয় হলেও বিপুল পরিমাণ গদ্য, গবেষণা গ্রন্থ, হাল্কা চালে শিশু কিশোরদের জন্য ছড়া ও গদ্য রচনা, ভ্রমণ ও স্মৃতিমূলক গদ্য, কবিতার জন্মকথা ইত্যাদি লিখেছেন। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ সযত্নে সরিয়ে রাখা ভালো। সারাজীবন রবীন্দ্রসাহিত্য, গান, নাটক, দর্শন ইত্যাদি প্রসঙ্গে অজস্র লিখেছেন। তাঁর গদ্যসংগ্রহ ইতিমধ্যেই ১০ খণ্ড অতিক্রম করে গেছে। প্রচলিত ধারার আত্মজীবনী লেখেননি, ধাঁচা সরিয়ে রেখে সম্পূর্ণ বিকল্প ধারায় লিখছিলেন আপনকথা, আপনজন ও আত্মজনদের চিঠিপত্রের প্রাসঙ্গিক ইতিহাস ও প্রয়োজনীয় তথ্য। তাঁর বাড়িতে ছিল।। বিপুল ও বিস্ময়কর গ্রন্থের সংগ্রহ। পেয়েছেন আঞ্চলিক থেকে সর্বভারতীয়। স্বীকৃত ও মান্য সমস্ত সাহিত্য পুরস্কার। বাংলাভাষায় কথা বলেন প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এই সমৃদ্ধ বাংলাভাষায় অজস্র লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, দুই বাংলার সারস্বতসমাজে নিরস্তর আলোচিত হয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি। ইদানীং যাঁরা নোবেল পুরস্কার পান তাঁদের অনেকেই তাঁর সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে উচ্চারিত হওয়ার যোগ্যই নয়, তবু তাকে নোবেল দেওয়ার জোরাল প্রস্তাব আসেনি। আশ্চর্য! ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ বাংলাদেশের বরিশালে তিনি জন্মেছিলেন, প্রয়াত হলেন ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল করোনার নিষ্ঠুর আক্রমণে। মাত্র ৮ দিনের মাথায় তার স্ত্রী বিশিষ্ট অধ্যাপক ও লেখক প্রতিমা ঘোষও একই রোগের শিকার হয়ে চিরবিদায় নিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের তিনতলায় ফ্ল্যাটটি আকস্মিকভাবেই ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রইল। আর আড্ডা বসবে না, দেখা যাবে না তরুণ কবি লেখকদের এস্ত চলাচল। একুশ শতকের সঙ্গে ছিল তার আত্মীয়তার বন্ধন। সব বন্ধন ছিন্ন করে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন, কিন্তু আমরা নিশ্চিত জানি, যতদিন যাবে এই বন্ধন নতুন নতুন বিভঙ্গে আমাদের উদ্দীপ্ত করবে আর স্মরণ করিয়ে দেবে তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তার মধুর স্মৃতির প্রতি আমরা প্ৰণত থেকে যাব অনন্তকাল।