প্রথমেই কবুল করি, এই লেখাটায় শঙ্খ ঘোষের সাহিত্যপ্রতিভা বিশ্লেষণের বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। তাঁর কবিতা বা নানা গদ্যরচনা নিয়ে অনেক আলোচনা-গবেষণা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অবশ্যই হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনোলোকে তার পরিসর নেই। আমি এখানে যা বলতে চাইছি, তা একেবারেই একান্ত ব্যক্তিগত কিছু উপলব্ধি ও স্মৃতিচারণা। তার বেশি কিছু নয়।
সেটা হবে ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপনের আয়োজন চলছে দেশ জুড়ে। সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যায় নজরে এল একটি রচনা— ‘দুই বসন্তে’ যার সূচনাবাক্যটি ছিল অনেকটা এইরকম : ‘সেই সৌম্য আয়তনের চতুর্দিকে আমরা অনেককাল ঘুরেছি।’ লেখক—শঙ্খ ঘোষ। তখন আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে বাংলা অনার্স পড়ি। আধুনিক কবিতা পড়তে ভালো লাগে। ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (নাভানা প্রকাশিত) পড়েছি, ‘দেশ’-এর পাতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পড়েছি। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবিতা তখনও পড়িনি। অথচ ওই ‘দুই বসন্তে’ লেখাটি আমাকে মুহূর্তে মুগ্ধ করে ফেলল। কথায় কথায় আমার শিক্ষক চিত্তরঞ্জন ঘোষের মুখে জানলাম শঙ্খ ঘোষের কৃতিত্বের কথা। জানলাম আধুনিক কবিতার বিষয়ে রচনা লিখে এম.এ. পরীক্ষায় তিনি নাকি ডাকসাইটে অধ্যাপক ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ৫০-এর মধ্যে ৩৮ নম্বর পেয়েছেন, যে শ্রীকুমারবাবুর হাত দিয়ে নম্বর গলত না মোটেই। যাইহোক, আরও জানলাম তিনি এক উদীয়মান বিশিষ্ট কবি। কিন্তু ঠিক সেই পর্বে শঙ্খ ঘোষ খুব বেশি কবিতা লিখছিলেন না, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬) তার বছর পাঁচেক আগেই প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। তার যথারীতি কলেজের পাট চুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হলাম।
১৯৬৪ সাল নাগাদ একদা শুনতে পেলাম বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তিন দিনের একটা বক্তৃতামালায় ভাষণ দেবেন। সেখানেই আমার প্রথম চাক্ষুষ দর্শন শঙ্খ ঘোষকে, অবশ্যই দূর থেকে। দেখলাম বন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে পাশে নিয়ে শ্রোতার আসনে বসে আছেন। চিনতাম না কাউকেই। আমার এক সহপাঠী বন্ধু দূর থেকে চিনিয়ে দিল। কাছে যাবার সাহস হয়নি আদৌ। যাইহোক, ততদিনে শঙ্খ ঘোষ অলোকরঞ্জন সুনীল শক্তি ও অন্যান্য সমকালীন কবিদের কবিতা পড়া রপ্ত করে ফেলেছি। এম.এ. পাশ করে পড়াতে ঢুকেছি নিজের কলেজ স্কটিশচার্চে। সেখানে বছর খানেক পড়ানোর পর সুযোগ এল যাদবপুরে ঢোকার। একবছরের ছুটি নিয়ে শঙ্খদা গেলেন আইওয়ায় আমন্ত্রিত কবি হিসাবে। সেই পদে যোগ দিলাম ১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর। একবছর বাদে শঙ্খদা ফিরে এলেও সৌভাগ্যক্রমে আমার চাকরিটা বজায় থাকল। সেই থেকে টানা চব্বিশ বছর তাঁর সঙ্গে একঘরে পাশাপাশি বসে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওঁর অবসর নেবার সময় পর্যন্ত। মানুষটাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। শিক্ষক হিসাবে ওঁর মতো দায়িত্বশীল আর কাউকে দেখিনি। অসুস্থ না হলে পারতপক্ষে কোনোদিন ক্লাস কামাই করতেন না। আমার লোভ হত ওঁর ক্লাস করার, কিন্তু অনুমতি পাইনি কখনও। সেই দুঃখ মেটাতাম ক্লাসের বাইরে ঘরোয়া আলোচনায়, চা-কফি খেতে খেতে যাদবপুরের ফ্যাকাল্টি ক্লাবের বৈকালিক আড্ডায়। যেখানে উপস্থিত থাকতেন চিত্তবাবু, সুবীর রায়চৌধুরী, অমিয় দেব, সৌরীন ভট্টাচার্য, নবনীতা দেব সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন মজুমদার। কথা বলতেন খুবই কম, শুনতেন মন দিয়ে ধৈর্য ধরে। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও কত মানুষজন আসতেন ওঁর কাছে নানা পরামর্শ নিতে। তাঁদের মধ্যে একেবারে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী যুবাকর্মী থেকে শুরু করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র নাট্যকর্মী অশোক মুখোপাধ্যায় বিভাস চক্রবর্তী লেখক দেবেশ রায় অরুণ সেন প্রমুখ কতজনই না ছিলেন! বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁরা আসতেন, যেমন যেতেন তাঁর উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের কিংবা উল্টোডাঙার ফ্ল্যাটে।
তাঁর কাছে বসেই শিখেছি বা শেখার চেষ্টা করেছি কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে পড়া বা পড়ানো উচিত। শঙ্খদার রক্তকরবী-বিসর্জন নাটক গোরা-চতুরঙ্গ উপন্যাস বা বিষ্ণু দে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়ানো আজ কিংবদন্তি হয়ে আছে। ছন্দ যেভাবে শেখাতেন তাও ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন। অন্যদিকে ভাষা ব্যবহার বা বানান সম্পর্কেও ছিল তাঁর নিরন্তর আগ্রহ। ক্লাসের বাইরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রছাত্রীদের সময় দিতেন, তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন। এমনকি একবার এমন হয়েছিল, উনি কিছুদিন ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাবেন। কিন্তু পাছে পাঠ্য কোর্স শেষ না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এক ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছিলেন আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে। অথচ কবি বলে কখনও খামখেয়ালি করতে দেখিনি। বিভাগের এক অন্যতম কঠিন ও দায়িত্বের কাজ রুটিন করা। সবাইকে তুষ্ট করে তাঁদের সময় মতো রুটিনে ক্লাস বসিয়ে নিজের ক্লাস বসাতেন। ঠাট্টা করে বলতাম— এ তো ‘সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব’!
আর একটা বড়ো প্রেরণা এনে দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে বিভাগে প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ওঁর আমেরিকা প্রবাসের সময় মূলত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের উৎসাহে বাংলা বিভাগে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ বিষয়ে এক প্রদর্শনী ও কবিতাপাঠের আয়োজন হয়েছিল। একটি সুন্দর পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছিল এই উপলক্ষ্যে, বিভিন্ন কবির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষাৎকারকে ভিত্তি করে। এই ধারার অনুসরণে পরবর্তী সময়ে মূলত শঙ্খদার সক্রিয় উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অনেকগুলি প্রদর্শনী— সতীনাথ ভাদুড়ি ও বিয়ু দে’র সাহিত্যকীর্তি বিষয়ে, বাংলা লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে শম্ভু সাহার তোলা রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের বিভিন্ন ফোটোগ্রাফ নিয়ে রবীন্দ্ররচনাবলির বিভিন্ন সংস্করণ নিয়ে, বিভূবিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে। প্রতিটি প্রদর্শনী সাজানো হত তার তত্ত্বাবধানে, এমনকি পোস্টারিং-এর জন্য প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনীয় লাইনগুলিও তিনি অনেক সময় নিজ হাতে বেছে দিতেন। প্রায় গোটা সময় জুড়ে উপস্থিত থাকতেন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের সান্নিধ্যে।
আসলে শিক্ষকতা যে কোনো একতরফা ব্যাপার নয়, শিক্ষক মঞ থেকে বলে যাবেন আর ছাত্রছাত্রীরা মুখ বুজে বিনা প্রশ্নে তাঁর বক্তৃতা নোট করে পরীক্ষা বৈতরণী পার হবে— সেটা উনি বিশ্বাস করতেন না। সর্বদাই থাকত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের একটা খোলা পরিসর। তাই ক্লাসঘরের বাইরে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন, শিক্ষা ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শান্তিনিকেতন পুরী বেড়াতে গিয়েও এটা লক্ষ করেছি। তিনি কখনওই পণ্ডিত অধ্যাপক হবার চেষ্টা করেননি। বাক্যজাল বিস্তার করে জনপ্রিয় হবার কথা ভাবেননি। ডাকঘর নাটকের অমল-এর মতোই তিনি বলতে পারতেন—‘আমাকে পণ্ডিত হতে বলো না পিসেমশায়’ ‘রক্তকরবী’ নাটকের অধ্যাপকের মতো ‘নিরেট নিরবকাশ গর্তের পতঙ্গ’ হতে চাননি তিনি। স্নেহে মমতায় নিঃশব্দ শাসনে ছাত্রছাত্রীদের মনে মনুষ্যত্বের প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করে দিতে চেয়েছেন— অধ্যাপনায় এবং তার নিজস্ব লিখনশৈলীর মধ্যেও। তাই পাদটীকা-কণ্টকিত উল্লেখ-ভারাক্রান্ত প্রবন্ধ রচনা করেননি কখনও। অথচ নিজস্ব বিশ্বাসে তিনি অটল, ঋজু, আপোষহীন— ব্যক্তিজীবনে যেমন তেমনি তার সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্বাসবোধের জগতেও। আমাদের অশেষ সৌভাগ্য আমরা এমন একজন ব্যক্তিত্বকে আমাদের মধ্যে পেয়েছিলাম শুধু কবি-প্রাবন্ধিক-সমালোচক হিসাবে নয়, শিক্ষক এবং সহকর্মীরূপে। তাঁর চলে যাওয়ার পরে বাস্তবিকই আমরা হয়ে গেলাম নিরভিভাবক, দিকশূন্যপুরের যাত্রী।
লেখক – পিনাকেশ সরকার