ইংরেজ শাসনাধীন বঙ্গে ইংল্যান্ড থেকে অনেক মানুষই এসেছিলেন, কেউ সরকারি আর কেউ কেউ গবেষণামূলক কাজের জন্য। তাদের মধ্যে অনেক ব্যাতিক্রমী বঙ্গবন্ধু আছেন যাদের বাংলার ইতিহাস -চর্চায়, সাহিত্যে, রাজনীতিতে এবং স্থাপত্যশিল্প অবদান অনস্বীকার্য। এখানে দুই ব্যাতিক্রমী বঙ্গবন্ধুর কথা তুলে ধরা হলো। পেশাগত দিক থেকে আলাদা হলেও বাংলার ইতিহাস -চর্চায় তাদের অবদান প্রশ্নাতীত। সেই দুই ব্যাতিক্রমী বঙ্গবন্ধু হলেন মাইকেল ক্যারিট এবং ডেভিড ম্যাককাচন।

মাইকেল ক্যারিট – এক কমিউনিস্ট আইসিএস

মাইকেল ক্যারিট একজন শেতাঙ্গ, তরুণ বয়সে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন আইসিএস হয়ে। সেই সময়, ব্রিটেন থেকে সীমাহীন ক্ষমতা হাতে নিয়ে যে-নবীন আমলারা ভারত শাসন করতে আসতেন, তারা জানতেন ধাপে ধাপে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে উঠে যাওয়াই তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তি। কিন্তু মাইকেল ক্যারিট অন্য ধারার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। অধ্যাপক-তনয় অসামান্য মেধাবী এই তরুণ এই বাংলায় আইসিএস হয়ে এসে, গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, সততা-নিষ্ঠা- আন্তরিকতা, সংস্কার, আবেগ এবং দারিদ্র লাঞ্ছিত নিরন্ন জীবনযাপন দেখে নতুন জীবনের হাতছানি অনুভব করেছিলেন। ছুটি কাটাতে কিছু দিনের জন্য গিয়েছিলেন লন্ডনে। সময়টা গত শতাব্দীর তিরিশের দশক। দুনিয়া জোড়া ঐতিহাসিক মন্দা আর হিটলার মুসােলিনির নাৎসি ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটছে আর অন্যদিকে মার্কসবাদী চিন্তাচেতনার নয়া উন্মেষ ও সমাজতন্ত্রের অনন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব। সব দেখেশুনে মাইকেল ক্যারিট ফিরে এসেছিলেন নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে।

অক্সফোর্ডের অন্যতম সেরা ছাত্র ক্যারিট মার্কসবাদকেই জীবনের ধ্রুবতারা করে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করলেন। কমিউনিস্ট আইসিএস। অকল্পনীয় অস্বাভাবিক এবং অসামান্য এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত। হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে থাকা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদও গ্রহণ করলেন এবং দলের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে সংযােগ ঘটল তার। মার্কসীয় দর্শন ও রাজনীতির বইপত্র গােপনে এনে এদেশের মেধাবী পার্টি-সংগঠকদের মতাদর্শে সমৃদ্ধ করতে শুরু করলেন।

রােমাঞ্চকর ঘটনাবহুল ক্যারিট জীবনের রহস্যময় অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে আছে গন্ধমূষিকপুরাণ গ্রন্থের পাতায় পাতায়। আছে তার ব্যথাবেদনা ও নানা জটিলতায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দুময় সময়ের কথা। চাকরি ছেড়ে নিজের দেশে আবার ফিরে গেলেন তিনি। অক্সফোর্ডেই গ্রহণ করলেন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনার নতুন জীবন। কিন্তু কেন? তার ইঙ্গিত আছে গন্ধমূষিকপুরাণ গ্রন্থে।

গ্রন্থটি অনলাইনে সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন – BUY NOW অথবা কলেজস্ট্রিট এ আমাদের স্টোর থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। যোগাযোগ – 15, Shyama Charan Dey St, College Street, Kolkata – 700073, West Bengal, India

ডেভিড ম্যাককাচন – বাংলার পটচিত্র ও মন্দিরশিল্প চর্চার জনক

পাল ও সেন আমলের পরবর্তীকালে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সারা বঙ্গদেশ জুড়ে যে বিপুল সংখ্যক মন্দির নির্মিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে প্রায় কোনো গবেষণাই হয়নি। বাংলার মাটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা মন্দির ও মন্দিরাশ্রিত পোড়ামাটির শিল্প সম্বন্ধে ১৯৬২ নাগাদ নেহাত শখ হিসেবে যে খোঁজ আরম্ভ করেন ডেভিড। জ্ঞানপিপাসা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম, অসীম ধৈর্য ও মনোবলের জোরে একটি দশকের মধ্যেই পোড়ামাটির অলঙ্করণযুক্ত স্থাপত্যগুলি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার পথে এগিয়ে যান তিনি। ফটোগ্রাফিক ডকুমেনটেশনের কাজে হাত দেন প্রথমে। ক্রমে তথ্য সংগ্রহ একাগ্র গবেষণায় পরিণত হয়। সেই গবেষণা যা সম্পূর্ণ করার লক্ষে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানেই কোনো দেব-দেউল, মসজিদ বা দর্গা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই তিনি পৌঁছে গেছেন তথ্য সংগ্রহ করতে। বাংলার পুরাকীর্তির সংরক্ষণের জন্য আক্ষরিক অর্থেই প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন শেক্সপিয়ারের আপন দেশের এই সাহেব!

কেম্ব্রিজের জেসাস কলেজের ছাত্র ডেভিড। ১৯৫৩ তে ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান ভাষা সাহিত্যে ‘ট্রাইপস’ পেয়ে স্নাতক হন। ৫৭ তে সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর হন। কেমব্রিজেই ‘টেগোর সোসাইটির’ একজন সদস্য ছিলেন ডেভিড। ভারতবর্ষ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহলের উদ্রেক হয় সেখান থেকেই। সেখানে প্রাচ‍্য সম্বন্ধীয় নানা বক্তৃতা সাগ্রহে শুনতেন তিনি। উচ্চশিক্ষা লাভের পর ডেভিড ফ্রান্সের দুটি বিদ্যালয়ে কিছু সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেন। তারপরই তিনি ঠিক করেন ভারতবর্ষে যাবেন, পড়ানোর কাজটা তিনি শান্তির আলয়ে করতে চান। সুযোগও মিলে গেল, যখন বিশ্বভারতী থেকে তাঁর আবেদন গৃহীত হল। ১৯৫৭ এর সেপ্টেম্বর মাসে ডেভিড পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন বিশ্বভারতীতে। কিন্তু সেই সময়ে সেখানকার উত্তপ্ত পরিবেশ এবং নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি তাঁকে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।

কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে ডেভিড অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৬০-এ। ‘ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ’ বিষয়টির সূচনালগ্ন থেকেই তিনি এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন ডেভিড। ছাত্ররা তাঁর পাণ্ডিত্য, ক্লাসে পড়ানোর ধরণ, ছাত্রদের প্রতি তাঁর সহজ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ—সব কিছু গ্রহণ করেছিল সাদরে। কলকাতায় বিভিন্ন মহলে পরিচিতি লাভ করছিলেন ডেভিড। তাঁর নিরহঙ্কার, সহজ প্রকৃতি, সাদামাটা বেশভূষা, অনাড়ম্বর জীবনযাপন, কৌতুকপ্রিয় স্বভাব, নানা বিষয়ে জ্ঞান ও জানার আগ্রহ থাকায় অনেকেই খুব সহজে তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এ দেশে। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল, দার্শনিক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব, অধ্যাপিকা গৌরী আয়ুব দত্ত, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু, লেখিকা প্রতিভা বসু, কবি নরেশ গুহ, ইতিহাসবিদ অশীন ও উমা দাশগুপ্ত, এমনই আরও অনেকে ছিলেন ডেভিডের বন্ধু।

পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আগ্রহ থেকেই হয়তো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সত্যজিতের প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠেন ডেভিড। তাঁদের একে অপরকে লেখা চিঠি, ডেভিডের মৃত্যুর পর সত্যজিতের লেখা নিবন্ধ এ কথার সাক্ষ্য বহন করে। সত্যজিতের প্রস্তাবে তাঁর ছবির সাবটাইটেল ইংরেজিতে রচনা করার দায়িত্ব নেন ডেভিড। ‘তিন কন্যা’ থেকে শুরু করে ‘সীমাবদ্ধ’ পর্যন্ত সত্যজিতের সব ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল রচনা করেছিলেন ডেভিড। সত্যজিৎ-ই হয়তো টেরাকোটা শিল্পের প্রতি ডেভিডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর ‘অভিযান’ সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন বীরভূমের টেরাকোটার মন্দির দেখে ডেভিডের আগ্রহ জন্মায় এই বিষয়ে। সেই আগ্রহ মাস কয়েকের মধ্যেই পরিণত হয় নেশায়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন, হাওড়া, বীরভূম, হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরের সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ডেভিড পৌঁছে গেছেন কখনো সাইকেলে কখনো বা দিনে পনেরো-কুড়ি মাইল পথ হেঁটে। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, ঘন জঙ্গলে সাপ-খোপের ভয়, সে সব অঞ্চলে থাকা-খাওয়ার চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা—কিছুই তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি।

পূর্ববঙ্গের শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতি, সেখানকার মানুষের সহজ সরল ব্যবহার, অতিথি-পরায়ণতা, আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া তাঁর মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেখানে হিন্দু, মুসলমান মানুষদের মিলিত প্রয়াসে, চিরাচরিত প্রথায় অনুষ্ঠিত দুর্গোৎসব তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। বেশীরভাগ সময় ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও গুজব রটনার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের বুকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়া, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্য থেকে এক নতুন দেশের জেগে উঠতে পারার প্রবল সম্ভাবনার কথা ডেভিড তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন নির্দ্বিধায়। মন্দিরশিল্প সম্বন্ধে তুলনামূলক গবেষণার জন্যে ডেভিড ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মন্দিরগুলি সম্পর্কেও আগ্রহী হন। হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে—যেমন বিহার, ওড়িশা, মধ্যপদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকে। এসব জায়গা থেকে প্রায় কুড়ি হাজারেরও বেশি মন্দির সম্পর্কে সুবিপুল তথ্য জোগাড় করেছেন। মন্দিরের স্থাপত্য বিবর্তন, মন্দির সজ্জা ও অলঙ্করণ বিন্যাস, মন্দিরের স্থপতি, আরাধ্য দেবতা বা প্রাচীন ভাস্কর্য ও মূর্তির বিষয়ে তথ্য আহরণ করে তা যত্নের সঙ্গে রেকর্ড করেছেন। আর এই কর্মযজ্ঞ তিনি চালিয়ে গেছেন কোনো ধরণের ট্রাষ্ট/ফান্ড বা সরকারী অর্থ সাহায্য কিম্বা অনুদান ছাড়াই।

তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা এবং বাংলার পুরাকীর্তি সম্বন্ধে গবেষণা- দুটি কাজের মধ্যে আশ্চর্য দক্ষতায় ভারসাম্য রেখে চলতেন ডেভিড। ক্লাসে যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের ইউরোপীয় আঠারো শতক, রোমান্টিক ড্রামা পড়াতেন, গ্যেটের ফাউস্ট, স্যাটানিক স্পিরিট কিংবা গালিভারের ব্যাখ্যা করতেন, কর্মক্ষেত্রে ছুটির দিনে শীর্ণ, রোদে পোড়া তামাটে চেহারার সেই ডেভিডই ক্যামেরা, মাপজোকের ফিতে, মন্দির-গাত্রে আগাছা সাফ করবার কাটারি হাতে চষে বেড়াতেন গ্রাম বাংলা। কখনো একা, কখনো বা সঙ্গে প্রিয় ছাত্র সুহৃদ কিম্বা অন্য কেউ। খুঁজে বের করতেন কোনো বিরল দোচালা, চৌচালা, নবরত্ন কিম্বা পঞ্চরত্ন মন্দির বা টেরাকোটার কোনো হারানো সম্পদ।

৩২ টি গুরুত্বপূর্ণ লেখায় ধরা পড়েছে সামগ্রিক ডেভিড ম্যাককাচন। শুধু জীবন – সান্নিধ্য স্মৃতি সুধা নয়, তাঁর গবেষণা কর্মের মূল্যবান মূল্যায়ণ করা হয়েছে বইটিতে। শুধুমাত্র বাঙালি তথা ভারতীয়দের পর্যালোচনা নয়, সেই সঙ্গে বিদেশি গবেষকদের এক মিলিত সম্মিলন। বিস্মৃত এক বিদেশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক দুষ্প্রাপ্য দলিল।

‘ডেভিড ম্যাককাচন চর্চা’ গ্রন্থটি অনলাইনে সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন – BUY NOW অথবা কলেজস্ট্রিট এ আমাদের স্টোর থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। যোগাযোগ – 15, Shyama Charan Dey St, College Street, Kolkata – 700073, West Bengal, India