সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৪০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে ১৫ নভেম্বর ২০২০ প্রয়াত হয়েছিলেন৷ করোনা-আক্রান্ত সৌমিত্র নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে করোনা- মুন্তও হয়েছিলেন কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুকে অনেকেই বিরাট উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের পতন বলে অভিহিত করেছিলেন ৷ অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কিন্তু তাঁর মৃত্যুকে সূর্যাস্তের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন : সকলে বলছেন, নক্ষত্রপতন৷ আমি তা বলছি না৷ আমি বলছি সূর্যাস্ত ৷ সূর্য যখন ডুবে যায়, পৃথিবীতে আঁধার নেমে আসে ৷ আজকের পৃথিবীতে সৌমিত্র বিহনে শুধুই আঁধার ৷

মৃত্যুর নরম মুহূর্তে অনেক সময়ই এমন মন্তব্য প্রায়ই লক্ষ করা যায়, আসলে যা অতিশয়োক্তি৷ প্রিয়জনের মৃত্যুতে বাড়িয়ে বলার প্রবণতা থাকেই ৷ কিন্তু সৌমিত্র প্রসঙ্গে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যে তার লেশমাত্র নেই ৷ সংস্কৃতির জগতে যেমন তিনি প্রশ্নাতীত নক্ষত্র, তেমনি তাঁর মৃত্যু গভীর অন্ধকার ডেকে এনেছে৷ তাঁর মৃত্যুর পর যে অন্ধকার নেমে এসেছে তা চিরকালই থেকে যাবে এমন বলার ধৃষ্টতা আমাদের নেই ৷ কারও মৃত্যুই চিরস্থায়ী অন্ধকার সৃষ্টি করে না, তবে সব মৃত্যু সমান হয় না ৷ বহুল প্রচলিত শব্দ ও উপমাই ব্যবহার করতে হয়, কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হাল্কা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু পাহাড়ের মতোই ভারী ৷ সহজে তাঁর শূন্যস্থান পূর্ণ হবে না ৷ একজন মানুষ একই সঙ্গে গান করছেন, কবিতা লিখছেন, নাটক লিখছেন, পরিচালনাও করছেন, ছবি আঁকছেন, চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করছেন এমন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিরল কিন্তু দেখা যায় না, বলা যাবে না৷ কিন্তু প্রতিভার বহুমুখিতাই শুধু নয়, উচ্চমান স্পর্শ করা বিরলই ৷ তাঁর দক্ষতা ও প্রতিভা ছিল সীমাহীন৷ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসাবে তাঁর খ্যাতি, কিন্তু তিনি ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা লিখেছেন প্রায় নিয়মিত ৷ বহু মৌলিক নাটক যেমন লিখেছেন, তেমনি বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ নাটক ভাষান্তরিত করে মঞ্চস্থ করেছেন তিনি ৷ ব্যস্ততম শিল্পী তাই দিনের পর দিন ঘরে বসে ভাষান্তরের সুযোগ করতে পারেননি ৷ তাঁকে আর পাঁচটা কাজের ফাঁকে, সময় বের করে নিতে হয়েছে ৷ বাঙালির ঘুম কেড়ে নেওয়া অভিনেতা, অভিনয় করার জন্য যাঁর বিকল্প খুঁজে পাওয়াই যায় না, তাঁর চরিত্রের সঙ্গে তথাকথিত বাঙালির আলস্য, বাঙালির দীর্ঘসূত্রিতা, সময়-জ্ঞানহীনতা, ইতিহাসবোধের অভাব, ইত্যাদি ভয়ংকর গুণাবলি ছিল না ৷  তিনি কোনো অলস সময় চুপচাপ পার করেননি৷ সবসময় কাজ করে গেছেন৷ সারা জীবন বলতেন, কাজ করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন একদিন ৷ তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে ৷ ৬ অক্টোবর ২০২০ নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও শ্যুটিং করেছেন ৷ শ্যুটিং থেকে ফেরার পর অসুস্থ বোধ করেন ৷ জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছিল ৷ তখনও তিনি মৃত্যুর সঙ্গে তিনপাত্তি খেলার মতো মানসিক দৃঢ়তায় টইটুম্বর ৷ ৮৫ বছর বয়সে এই দৃঢ়তা কল্পনার সীমানার বাইরে, সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না ৷

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন, সৃষ্টিকর্ম এবং সামাজিক-রাজনৈতিক দৃটিভঙ্গি থেকে প্রত্যেক সংসৃকতিকর্মী সংগঠক ও সৃজনশীল ব্যক্তি ও সংগঠনের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ আছে ৷ আপাদমস্তক একজন আদর্শ বাঙালির প্রতিবিম্ব হয়েও অসামান্য সময় চেতনায় সমৃদ্ধ কর্মী মানুষের প্রতীক ছিলেন তিনি ৷ এমন শৃঙ্খলাবোধ এবং মনোযোগী মননশীল মানুষ না-হলে, এক জীবনে এত কাজ করা সম্ভব হয় না ৷ তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কিন্তু কোনো পরিচালক অভিযোগ করেননি যে, তাঁর জন্য শ্যুটিং স্থগিত রাখতে তিনি বাধ্য হয়েছেন৷ কেউ বলেননি, তাঁর অহমিকা বা অসৌজন্য অন্য সহশিল্পীদের ক্ষুব্ধ করেছে বা অভিমানী করে তুলেছে ৷ বরং উলটোটাই ঘটেছে ৷ তুলনায় অপরিচিত শিল্পীদের সঙ্গেও তিনি নিজে আলাপ জমিয়ে আপন করে নিয়েছেন, তাঁদের ভয় ও সংকোচ কাটাতে সাহায্য করেছেন৷ কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনের আনন্দে কবিতা ও নানা ধরনের গদ্য নিয়মিত লিখেছেন ৷ প্রবীণ অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সিটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রথম তিনি সৌমিত্রর কবিতা পড়েছিলেন ৷ সেকথা বলতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অন্যান্য কবির মতোই আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠেন, ওটাই ছিল আমার প্রথম ছাপা কবিতা ৷ কবিতা রচনা ও অনুশীলনের জন্য অখণ্ড অবসর তিনি কোনো সময়েই পাননি, কিন্তু খণ্ড খণ্ড অবসর ব্যবহার করেছেন তিনি ৷ অভিনয় জগতে সুখ্যাতির উচ্চ শিখরে উঠেও তিনি তাঁর সৃজনক্ষেত্রকে অবহেলা করেননি ৷ সাধারণ ছোটো পত্রপত্রিকার প্রতিনিধিদেরও তিনি যথাযথ মর্যাদা দিতে জানতেন৷ কোনো কবি বা লেখক শিল্পী তাঁর কাছে যথাযোগ্য ব্যবহার পাননি এমন অভিযোগ তোলেননি৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসংগ্রহের সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, গল্পকার আনসারউদ্দীনের গল্প পড়ে তিনি আলাপ করেছিলেন লেখকের সঙ্গে এবং ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন নিজের অভিমত ৷ আনসারউদ্দীনকে চিঠির আকারে লিখেছিলেন কিছু কথা৷ সেই লেখাটি গদ্যসংগ্রহর তৃতীয় খণ্ডে দেওয়ার জন্য অসুস্থ শরীরেও তাঁকে ফোন করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি ৷ একইরকম অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন বর্ধমানের বাচিক শিল্পী ও চ্যাপলিন গবেষক দেবেশ ঠাকুরও ৷ এই প্রসঙ্গগুলি সৌমিত্রবাবুর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলিই স্পট করে তোলে ৷ বড়ো মাপের শিল্পী হওয়ার জন্য উদার মন ও শিল্পমানস গড়ে তোলা কতটা জরুরি তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বিশ্লেষণ করলেই অনুভব করা যায় ৷

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে কোনো আলোচনাই তাঁর সামাজিক- রাজনৈতিক তথা মতাদর্শগত অবস্থানের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সম্ভব নয় ৷ বস্তুত বামপন্থার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ও সমর্থন, কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না ৷ পারিবারিক সাংসৃকতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা তার মননশীল জীবনচর্যাকে অনিবার্য করে তুলেছিল ৷ পারিবারিক অনুকূল পরিবেশে অতি অল্প বয়স থেকেই নাটক, কবিতা, আবৃত্তি ও সাহিত্যপাঠের আকর্ষণ ও অভ্যাস তাঁর জীবনে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল ৷ গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বামপন্থীদের উত্তাল আন্দোলন, শিক্ষকদের ধর্মঘট, ট্রাম-শ্রমিক আন্দোলন, এক পয়সা ট্রামভাড়া বৃদিধর প্রতিবাদে আন্দোলন থেকে শুরু করে জীবন জীবিকার নানা প্রাঙ্গণে আন্দোলন সংগ্রামের যে ঢেউ উঠেছিল, সারা রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনে তার গভীর ও স্থায়ী প্রভাব পড়েছিল ৷ বামপন্থী গণআন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমিতে বিকশিত সাংসৃকতিক পরিমণ্ডলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনচেতনা, মনন ও ভাবনার জগৎ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল ৷ অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মধ্যবর্তিতায় যা হয়ে উঠছিল উজ্জ্বলতর ৷ পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব তাই তাঁর মনে কোনোদিন কোনো রেখাপাত করেনি ৷ মননশীল বামপন্থী সংস্কৃতির ধারার উজ্জ্বল ফসল হিসাবেই বিকশিত হয়েছিলেন তিনি ৷ তাই তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে কোনো অস্পটতা ছিল না ৷ ছিল না কোনো আকস্মিক বিপর্যয় বা ছন্দপতন ৷ মননশীল রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বামপন্থী এবং অসাধারণ প্রতিভাবান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে, স্বভাবতই নক্ষত্রপতনের বেদনা এবং সূর্যাস্তের অন্ধকার একই সঙ্গে আমাদের আলোড়িত করেছে ৷ তাঁর প্রয়াণ যে বেদনা ও অভাববোধ তৈরি করেছে তা সহজে বিলীন হবে না৷ এবছর ১৯ জানুয়ারি তাঁর প্রথম জন্মদিবস যখন তিনি আর শারীরিকভাবে আমাদের মধ্যে নেই ৷ কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সৃজনপ্রতিভার অনন্য সম্ভার৷ এখন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নবনব আবিষ্কার ও উন্মোচনে তাঁর পুনর্জন্ম ঘটবে ৷ আমরা অবিশ্বাস্য উন্মাদনায় তাঁকে নতুন করে নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাব ৷ আরও এক নতুন সৌমিত্রর সন্ধানে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে যেতে হবে তাঁর কাছে, তাঁর সৃজনসম্ভারের গভীর থেকে গভীরতর তলদেশ স্পর্শ করে বিস্ময় বিমূঢ় কণ্ঠে আমরা বলে ওঠার সুযোগ পাব যে, তাঁকে আমরা এত সমসাময়িক হয়েও ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারিনি ৷ যত দিন যাবে যত দূরত্ব বাড়বে, ততই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করা যাবে৷ প্রকৃত অর্থেই এখন তিনি বাঙালির আইকন ৷