সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে একটু দ্বিধা হয় যে, কোন দিক থেকে বলব, কী বলব! প্রশংসার জন্য যে বাণী দরকার তা তো পুরোনো হয়ে গেছে৷ তাছাড়া এটা করে লাভ কী? তা একটা সোনার অলংকারে সোনালি রং করা হবে৷ আর সে ধৃষ্টতাও আমার নেই৷ তাঁর সঙ্গে মিশে অথবা মেশার আগে থেকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে যেটুকু বুঝেছি, তিনি ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি, শিক্ষিত বাঙালি, ঐতিহ্য রক্ষাকারী বাঙালি, পরিচ্ছন্ন বাঙালি৷ শিল্প-সাহিত্য-সংসৃকতির সর্বক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, এটা আমরা সবাই দেখেছি৷ তার জন্য যে শুদ্ধতা রক্ষা করতে হয়, নিজের জীবিকা রক্ষা করে সেই শুদ্ধতা তিনি রক্ষা করেছেন৷ সেদিক থেকে বাঙালির কাছে তিনি প্রণম্য৷ মহাকালের নিয়মে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে, কিন্তু একটা মহিরুহের পতন যখন হয়, তখন তার শিকড়টা থেকে যায় অনেক গভীরে৷ তার পতনে একটা বিরাট চাঙড় উঠে আসে, মাটির বুকে ব্যথা হয়, যন্ত্রণা হয়৷ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার শিকড়ও রয়ে গেছে মানুষের অন্তরের অনেক গভীরে৷ সেই বিয়োগযন্ত্রণা অপরিসীম৷ বিবেকানন্দর একটা কথা মনে পড়ে, তিনি বলেছেন যে, ব্যথার জায়গা থেকে যন্ত্রণার জায়গা থেকে মনটাকে সরিয়ে নাও৷ আমি এটা আমার ছাত্রজীবন থেকেই বুঝেছি, সে শারীরিক ব্যথাই হোক আর মানসিক ব্যথাই হোক৷ কিন্তু কীভাবে সেটা করব?
আমার মা যখন চলে গেলেন তখন মায়ের ওই শেষ অবস্থাটা আমি ইচ্ছে করেই দেখিনি৷ কাছেই ছিলাম, কিন্তু দেখিনি৷ কারণ মায়ের শেষ যে ছবিটা আমার কাছে জীবন্ত, তা হল, মা আমাকে বকছে কারণ আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছিলাম; আর আমার চোখে জল দেখে মা আমাকে মিটি কথা বলছে, তারপরে আমি মা-কে আদর করছি, বলছি—মা আজ তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে? এইটা আমার কাছে জীবন্ত, এর পরের কোনো দৃশ্য আমার চোখের সামনে নেই৷ এর পরের সমস্ত ঘটনা আমি অস্বীকার করব৷ আমার বড়োভাই, যে ছিল আমার পিতার মতো, আমাকে মানুষ করতে পেরেছে কিনা জানি না কিন্তু আমাকে রক্ষা করেছে৷ তার মৃত্যুতেও আমি সেই শেষদৃশ্য ইচ্ছে করেই দেখিনি৷ তার আগের দৃশ্যটা ছিল— আমরা হেসে গল্প করছি, দাদা হাসছে আমিও হাসছি৷ ওইটাই আমার কাছে শেষ দৃশ্য৷ ওই দৃশ্যের পরে আমি আর কোনো দৃশ্য দেখতে চাই না৷ আমার এক প্রিয় বন্ধু যে আমাকে জীবনের সন্ধান দিয়েছিল, তার বোধের জায়গাটা ছিল খুব তীব্র৷ তার সঙ্গে অনেক তর্কাতর্কি হত, হয়তো হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম, কিন্তু পরদিন সবাই দেখত আমরা গলাগলি করে চলেছি৷ সে যখন মারা গেল আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে পিজি হাসপাতালে হাজির হয়েছি, কিন্তু তাকে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামাচ্ছে সেই দৃশ্যটা আমি দেখিনি৷ দেখলে সেই দৃশ্যটা আমি অস্বীকার করব কেমন করে? আমার জীবনসঙ্গিনী আমার স্ত্রী যখন গত বছর চলে গেল, আমি তখন ওপরের ঘরে; সেই ক্রন্দনধ্বনিটা আমার কানে এসেছে, কিন্তু আমি নামিনি৷ তাকে নিয়ে গেল৷ আমি স্তদ্ধধ হয়ে থেকেছিলাম ঘরের ভেতরে৷ আমি দেখিনি সেই দৃশ্য৷ আমি জানি ওটা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু আমি অস্বীকার করতে চাই৷ সে আমার হাত ধরে আছে, সেই দৃশ্যই আমার কাছে জীবন্ত, আমি সেই দৃশ্যই রক্ষা করতে চাই৷ পুলুদার সঙ্গে আমার শেষ দৃশ্য যেটা, সেটা হল আমরা হো হো করে হাসছি৷ একটা জায়গায় আমরা একসঙ্গে ইন্টারভিউ দিচ্ছি দুজনে পাশাপাশি বসে, দুজনেই মজার কথা বলছি, হো হো করে হেসে পুলুদা আমার পিঠে চাপড় দিচ্ছে—পরান, কী যে বল তুমি! এইটা আমার কাছে জীবন্ত৷ এর পরের কোনো দৃশ্য যত সত্যই হোক সেটা আমি অস্বীকার করব৷ এতে লোকে আমাকে পাগল বলুক, মূর্খ বলুক, নির্বোধ বলুক, আমার কিছু যায় আসে না তাতে৷ আমি জানি যে ওটা সত্য, মহা কালের নিয়মে যে-সত্যের থেকে পৃথিবীতে কেউই রেহাই পাবে না, কিন্তু যখনই ওটা মনে পড়বে আমি সেই সজীব দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে নিয়ে আসব৷ ওই ব্যথার সঙ্গে আমি লড়াই করব৷ এতে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে, আমার মানসিক কট তৈরি হবে, কিন্তু মনে হয় আমি জিতে যাব, কারণ সেই দৃশ্য আমার কাছে জীবন্ত৷ সেই দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে ওই মানুষটা আমার কাছে বেঁচে আছে৷ সত্যিই তো বেঁচে আছে, কারণ এসব মানুষের মৃত্যু হয় না, মৃত্যু ঠোক্কর খেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে চলে যায়৷ সেইভাবে পুলুদা এখনও আমার কাছে জীবিত৷ দেশের মানুষের কাছে, দেশের বাইরের মানুষের কাছে সে এখনও জীবিত৷ আর চিরকাল জীবিত থাকবে—যতদিন চলচ্চিত্রশিল্প জীবিত থাকবে৷
এই আলোচনা করতে গিয়ে কিছু স্মৃতির কথা আমার মনে পড়ছে৷ আমি আর পুলুদা একই কলেজে পড়তাম৷ সিটি কলেজে৷ আমি যখন ঢুকলাম সেটা ১৯৫৫ সাল, পুলুদা সে-বছর ফাইনাল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ নবীনবরণের সময় আমাদের হাতে একটা স্যুভেনির দেওয়া হয়েছিল, তাতে পুলুদার লেখা একটা কবিতা ছিল—গরঠিকানিয়া৷ সেটা আমার কাছে বহুদিন ধরেই ছিল৷ তারপর আমি যখন চাকরিতে ঢুকলাম ষাটের দশকের প্রথম দিকে, তখন আমার বাইশ-তেইশ বয়স, সেই সময়ে আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সিনেমাতে দেখছি৷ দেখলাম অভিযান সিনেমাটা৷ সেখানে একটা দৃশ্য এরকম যে—ওয়াহিদা রহমান দূরে বসে আছে, আর সৌমিত্র সেখানে রাজপুত, একমুখ দাঁড়ি, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে এসে এক বোতল মদ ঢকঢক করে গিলছে, পুরো বোতল উপুড় করে চিবুকটা উঁচু করে৷ ক্যামেরা ধরে রেখেছে তার মাথা থেকে বুক, তার উঁচু করা চিবুক থেকে কণ্ঠনালী৷ এই দৃশ্যটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল৷ আমার মনে হয়েছিল তা মূর্ত যৌবনের প্রতিরূপ৷ একটা পুরুষ সে তার সমস্ত শগুি দিয়ে জগতের সমস্ত গরল পান করছে৷ পান করে সে নীলকণ্ঠ হচ্ছে৷ আমার মনে হয়েছিল, আহা, এই পৌরুষটাকে আমি যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম৷ কিন্তু ভাবতাম সে ইচ্ছে তো কখনও সফল হতে পারে না৷
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমি থিয়েটার করছি৷ তারপর বহু দিন কেটে গেল, আমি টিভি সিরিয়ালে অনেক অভিনয় করছি, এই সময়ে গৌতম ঘোষের ‘দেখা’ ছবিতে আমি অভিনয় করলাম, সৌমিত্রদার সহচরের চরিত্রে৷ সেই আমার প্রথম সৌমিত্রদার সঙ্গে ছবিতে কাজ করা৷ সেই ছবিতে একটা শট দেওয়ার পরে সৌমিত্রদা গৌতমকে বলল—এত দিন হিংসে করার মতো লোক পাইনি আমি, এবার একজন হিংসে করার মতো লোক পেলাম৷ এটা আমার কাছে যে কত বড়ো প্রাপ্তি তা বলে বোঝানো যায় না, জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার থেকেও মনে হয় বড়ো৷ আমি শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছিলাম৷ তারপর তাঁকে আমার অভিযান ছবিটা দেখার অনুভূতির কথা বললাম৷ তবে জড়িয়ে ধরার আকুলতার কথাটা বলিনি, কারণ সেটা যদি বলে দিতাম তাহলে তখনই হয়তো বলতেন, এসো জড়িয়ে ধরো৷ তাহলে ব্যাপারটা হালকা হয়ে যেত৷ কিন্তু আমি তাঁকে কলেজের স্যুভেনিরে তাঁর লেখা সেই কবিতাটার কথা বলেছিলাম৷ তিনি শুনে উচ্ছ্বসিত৷ বললেন—সেই কবিতা আছে তোমার কাছে! ওটা আমার জীবনের প্রথম ছাপা হওয়া কবিতা৷ তোমার ভালো লেগেছে শুনে খুব ভালো লাগছে৷
তার অনেক দিন পর একটা সিরিয়ালে, সম্ভবত বীরেশদার পরিচালনায় ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, সেখানে সৌমিত্রদা অভিনয় করছেন একটা কৃপণ ধনী বুড়োর চরিত্রে, পরিবারের সবাই তাকে একটু অন্য চোখে দেখে বলে একাকিত্বে ভোগেন, যদিও সবাইকে খুব ভালোবাসেন৷ সেখানে আমি এক মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করছি যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অহিংসায় বিশ্বাসী কিন্তু তাঁর ছাত্ররা সহিংস আন্দোলনে আগ্রহী, ফলে ছাত্রদের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ায় তাঁরও একাকিত্বের জীবন৷ এইরকম অবস্থায় একটা দৃশ্য, মাস্টারমশাই একটা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, খোলা জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে তাঁর চোখে মুখে, মাস্টারমশাই গাইছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, তাঁর চোখে জল৷ গাইতে গাইতে হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন তাঁর সঙ্গে যেন আরও কেউ গাইছেন গলা মিলিয়ে৷ মুখটা ফিরিয়ে দেখলেন—সেই বৃদধ ভদ্রলোক, সেই গান ধ্বনিত হচ্ছে তাঁরও কণ্ঠে৷ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গাইতে গাইতে ধীরে ধীরে দুজনে দুজনের দিকে এগিয়ে আসলেন, তারপর চোখে জল নিয়ে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন৷ বীরেশদা বললেন—‘কাট’৷ কিন্তু পরান বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও কেঁদে চলেছে৷ বীরেশদা বললেন, শট শেষ হয়ে গেছে, এখন কান্না থামাও, মাস্টারমশাইয়ের এখন আর কাঁদার দরকার নেই৷ কিন্তু মাস্টারমশাই তো কাঁদছে না, তখন পরান বন্দ্যোপাধ্যায় কাঁদছে৷ চরিত্রের চোখের জল তখন অভিনেতার চোখের জলে রূপান্তরিত হয়েছে৷ তারপর আমরা যখন গিয়ে বসলাম, আমি বললাম, এটা আমার আজকের স্বপ্ন নয়, এটা অনেক বছর আগের এক স্বপ্ন, আজ যে এভাবে মিলে যাবে আমি ভাবতে পারিনি৷ সৌমিত্রদাকে বললাম—তোমাকে আমার অভিযান ছবি দেখার অনুভূতির কথা বলেছিলাম, কিন্তু সেই ছবি দেখে এই ইচ্ছে জেগে ওঠার কথা তখন বলিনি; আজ আমার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সফল হল৷
সেদিন আমি যে কী আনন্দ পেয়েছিলাম বলে বোঝানো যায় না৷ আমি অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাস করি না, ভগবানে বিশ্বাস করি না; ঘটনা ঘটে, হঠাৎ মিলে যায়, আমি বলি অ্যাক্সিডেন্ট৷ সেদিন যদি অন্য কেউ অভিনয় করত, এই ঘটনা তার সঙ্গে ঘটত৷ ঘটনাক্রমে আমার সঙ্গে ঘটে গেল৷ এ আমার পরম সৌভাগ্য৷
সৌমিত্রদা আনন্দ পেয়েছিলেন৷ তাঁর অসাধারণ রসবোধ ছিল৷ অসাধারণ রসিক৷ তাঁর প্রাণোচ্ছলতার তুলনা হয় না৷ আমরা যখন মেকআপ-ভ্যানে বসে থাকতাম, কমবয়সি ছেলেমেয়েদের সামনে সংযত হয়ে কথা বলতে হত৷ কিন্তু সৌমিত্রদার ভেতরে শৈশব বেঁচে ছিল, কৈশোর বেঁচে ছিল, যৌবন বেঁচে ছিল, প্রৌঢ়ত্ব বেঁচে ছিল, বার্ধক্য বেঁচে ছিল৷ তিনি ঠিক কী সেটা ধরা যেত না৷ সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন, সবার সঙ্গে কথা বলতেন৷ নিজে এত বড়ো শিল্পী বলে কোনো অহংকার প্রকাশ করতেন না৷ আর আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, নিজের ব্যগুিগত দুখ-যন্ত্রণা নিয়ে তিনি কখনও কারও সঙ্গে আলোচনা করতেন না৷ অসাধারণ ছিল তাঁর জীবনবোধ৷ আমি আমার আইপিটিএ-র জীবনে অনেক কিছু শিখেছি৷ অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ আমি দেখেছি সেই অভিজ্ঞতা সৌমিত্রদার সঙ্গে মিলে গেছে৷ মানুষের প্রতি সহমর্মিতার জন্য তিনি অনন্য৷ সমাজ-পরিবর্তন অনেকেই চায়৷ অনেকেই সমাজ গড়ে তোলার দায় বহন করতে চেটা করে৷ শিল্পী-সাহিত্যিকরা তা পালন করেন নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে, সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়ে৷ সৌমিত্রদা আমৃত্যু সচেতনভাবে সেই দায়িত্ব পালন করার চেটা করে গেছেন, অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে, কবিতার মধ্যে দিয়ে, জীবনাচরণের মধ্যে দিয়ে৷ কোনো দিন তা থেকে সরে আসেননি৷
জীবনে তাঁর দুঃখ – কষ্ট ছিল না এমন তো নয়৷ অনেক দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই জীবন কাটিয়েছেন৷ জাগতিক যে দুঃখ-যন্ত্রণা, জীবিকার ক্ষেত্রে দুঃখ-যন্ত্রণা পারিবারিক দুঃখ যন্ত্রণা এবং জীবিকার স্বার্থে এমন কিছু কাজ করতে হয় যা সবসময়ে ততটা সৃজনশীল হয় না, মনোমতো হয় না, সেই দুঃখ-যন্ত্রণা তাঁর ছিল৷ সেসব সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে অনেক কথাও হয়েছে৷ কিন্তু আমি আমার জীবনে যেটা বিশ্বাস করি, পালন করার চেষ্টা করি, যে, নিজের যন্ত্রণার কথা কাউকে বলতে যেও না যতক্ষণ না জানতে চাওয়া হচ্ছে, বা সেরকম পরিবেশ তৈরি হচ্ছে৷ কারণ লোকে তোমার আনন্দময় রূপটাই দেখতে চায়৷ যেমন, আমার এক অত্যন্ত দুখজনক পারিবারিক অসময়ের কালে আমার অনেক পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন পরে দেখা হল, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে কেমন আছি জানতে চাইল, আমি তখন তাকে আমার সেইসময়ের দুর্যোগের কথা বলিনি, কারণ সে সেই দুখ বোঝার মতো জায়গায় নেই, সে আমি ভালো আছি সেটাই জানতে চায়৷ পুলুদাও তেমনই, সচরাচর নিজের দুখের কথা কাউকে বলতেন না৷ অনেক লোকের সঙ্গে মিশতেন, নতুুন লোকের সঙ্গে পরিচিত হতেন৷ তারা তাঁর আনন্দময় সৃষ্টিশীল রূপটাই দেখতে পেত৷ নিজের বেদনা নিজের মনেই ধরে রাখতেন৷ এমন অনেক ব্যাপারে আমার সঙ্গে পুলুদার মনের মিল হত৷ আমার যে জীবনের শিক্ষা, দেখতাম তিনি তা বহু আগে থেকেই অর্জন করে রেখেছেন৷ জীবনে প্রয়োগ করছেন৷
আমার জীবনের এটা একটা বড়ো আশীর্বাদ যে, আমার সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষের পরিচয় ঘটেছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, এক সঙ্গে অনেক কাজ করার সুযোগ হয়েছে৷ হাসি আড্ডায় বহু ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত আমরা যাপন করেছি৷ এটা আমার জন্য মহা কালের একটা প্রসাদ৷ তাঁর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হওয়ার নয়৷ তাঁর মৃত্যু হতে পারে না৷ মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করতে পারে না৷ যিনি অনেক আগেই লিখেছেন—আয় মৃত্যু তোর সঙ্গে তিন তাস খেলি—তিনি তো মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছেন৷ আমার কাছে তাঁর মৃত্যু হয়নি৷ এসব মানুষের মৃত্যু হয় না৷ স্মৃতির মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে তাঁরা চিরকাল বিরাজ৷