সৌমিত্র সব দিক থেকেই আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে, ছায়াছবির জগতে, একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র৷ আমার দীর্ঘ জীবনে অনেক শিল্পী নিয়ে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে এবং বহু গুণী শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, সৌমিত্র একদিক থেকে তাদের সবার থেকে আলাদা৷ ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী বরাবরই আমাদের এখানে প্রচুর ছিলেন৷ আমি নিজে যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি তাঁদের মধ্যে কানন দেবী থেকে শুরু করে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল—এঁদের সঙ্গে কাজ করতে করতে—কমল মিত্র, সন্ধ্যারানি, তারপর উত্তম-সুচিত্রা, এরকম বহু ভালো শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে৷ সৌমিত্র খুবই গুণী শিল্পী, খুবই ভালো শিল্পী—এটা নতুন করে বলার কোনো দরকার করে না৷ কিন্তু সৌমিত্রর বিশেষত্ব ছিল দুটো জায়গায়, এক হচ্ছে—শুধুমাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্যেই ও নিজের প্রতিভাকে সীমাবদ্ধ করে রাখেনি, এটা এখন সবাই জানেন যে এরকম কত কত শাখাতে ওর অবাধ বিচরণ ছিল৷ পত্রিকা সম্পাদনা করেছে, কবিতা লিখেছে, আবৃত্তিকার এত ভালো, নাটক নির্দেশক, নাটককার, মঞ্চের অভিনেতা, চলচ্চিত্রে অভিনেতা—এইরকম৷ কিন্তু আরও যে-দুটি বিশেষ গুণের জন্য আমি সৌমিত্রকে বারবার খুব প্রশংসা করব, সেটা হচ্ছে এই যে,—এত নাম করা সত্ত্বেও, এত গুণী হওয়া সত্ত্বেও, ওর আচারব্যবহার ইত্যাদি এত সহজ সরল সাধারণ এবং সাবলীল ছিল, যার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হতে পারে না৷ ও যখন কাজ করতে আসত, কেউ মনেই করতে পারে না যে এত বড়ো একজন শিল্পী ফ্লোরে কাজ করছে৷ এত ডিসিপ্লিনড, সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা, কেউ যেন ওর পর নয়৷ সৌমিত্রর মুখ দেখেই বোঝা যেত ওর চোখ দুটো হাসছে৷ আমার সঙ্গে এগারোটা ছবি করেছে৷ সব কথা বলতে গেলে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে৷ দুটো ছবি—‘সংসার সীমান্তে’ আর ‘গণদেবতা’ সম্পর্কে আমি কিছু বলব৷
সংসার সীমান্তে ছবিতে ও অভিনয় করছিল চোরের ভূমিকায়৷ একেবারে ছিঁচকে চোর৷ পটভূমি ছিল একটা অত্যন্ত দারিদ্র্যক্লিষ্ট গণিকাপল্লি৷ সেই ছবিতে সৌমিত্র চোরের ভূমিকায় কাজ করছে, সন্ধ্যা রায়ও কাজ করছে নায়িকার ভূমিকায়৷ তার প্রথম দৃশ্যটাই আছে, তুমুল ঝড়বৃটির রাতে চোর এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে তাড়া খেয়ে মরিয়ার মতো ঢুকে পড়েছে এই গলিতে, এবং এত রাত যে আর-সব মেয়েরাই যে-যার ঘরে ঢুকে গেছে, শুধু একটি মেয়েই তার কেরোসিনের লম্ফ জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে, তার কারণ রাতে অন্তত দুটো টাকা রোজগার না করলে তার খাওয়া জুটবে না৷ সেই সময়ে সৌমিত্র অর্থাৎ অঘোর বলে চরিত্রটা সেখানে গিয়ে পড়ে এবং তারপর সেই মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ আমার মনে আছে, এই শুটিংটা যখন হচ্ছে তখন জানুয়ারি মাস, কলকাতার ওপর দিয়ে তখন শৈত্যপ্রবাহ চলছে৷ একটা আউটডোর লোকেশনে শুটিংটা হচ্ছে৷ দমকল নিয়ে এসে দুটো দমকল মেশিন শূন্যে জল ছুঁড়ছে, আর সেই জল যখন নিচে পড়ছে, একটা প্রপেলার দিয়ে হাওয়া চালিয়ে আমরা ঝড়বৃটির এফেক্ট তৈরি করার চেষ্টা করছি আর তার ভেতর দিয়ে সৌমিত্র দৌড়ে আসছে; তাড়া খেয়ে দৌড়ে এসে এদিকওদিক খুঁজে খুঁজে সে রজনীর সেই ছোট্ট বারান্দায় এসে পৌঁছল৷ নানা কারণে তখন রাতের শুটিং রাতেই করতে হত, কারণ সেটা আউটডোর শুটিং৷ জানুয়ারির ওই ঠান্ডার মধ্যে গভীর রাতে আমরা গরম পোশাকআশাক পরে শীতে কাঁপছি, তখন সৌমিত্র অর্থাৎ অঘোরের পোশাক হচ্ছে একটা ছেঁড়াখোঁড়া হাফশার্ট আর ধুতি, যেটা কোমর পর্যন্ত বাঁধা৷ তাকে ঊনত্রিশ বার সেই শটটা দিতে হয়েছিল, নানা কারণে৷ কোনোবার টেকনিক্যাল কারণে বা অন্য কারণে৷ ঊনত্রিশ বার সেই ঝড়জলের রাতে ওকে এই শটটা দিতে হয়েছে, তবু সবসময়ে মুখে হাসি৷ সবসময়ে বলত, ঠিক আছে তো, আর একটা শট নেবেন নাকি? কাজের প্রতি এই যে নিষ্ঠা, এই যে মিশে যাওয়া, এটা খুব একটা দুর্লভ গুণ বলে আমি মনে করি৷
সংসার সীমান্তে ছবিতে আরও একটা ব্যাপার ছিল, প্রচুর মহিলা ওই ছবিতে কাজ করেছিলেন৷ পল্লির বাসিন্দা বিভিন্ন মহিলা৷ পঁচিশ-ছাব্বিশ জন ছিলেন৷ এই এত চরিত্রকে নিয়ে গিয়ে, তাদের মেক আপ করে সকাল আটটার মধ্যে ফ্লোরে হাজির করতে গেলে, রাত তিনটে থেকে তাদের বাড়ি থেকে পিক আপ করতে হয় এবং পরপর পরপর মেক আপ করতে হয়৷ সেটা তাদের জন্য খুব অসুবিধাজনক অবস্থা৷ যদিও মুখে কিছু বলে না কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, এদের অসুবিধা হচ্ছে৷ তখন সৌমিত্র বলল, কিচ্ছু ভাববেন না, আমি নিজে সবার আগে আসব, তাহলে কারও কিছু অভিযোগ থাকবে না৷ এবং হলও তাই৷
গণদেবতা ছবি করার সময়ের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে৷ গণদেবতা সরকারের হয়ে করেছিলাম৷ তারাশংকরের ওই উপন্যাসের চিত্রনাট্য যখন করলাম, দেখা গেল তাতে প্রায় দেড়শো চরিত্র৷ বিশাল ইউনিট, তার সঙ্গে আমাদের টেকনিশিয়ানরা মিলে প্রায় দুশো-আড়াইশো লোক৷ আমরা বীরভূমে চলে গেলাম, একটা জায়গায় ক্যাম্প করে শুটিং শুরু করলাম৷ ওই ছবিতে একটা বড়ো সিক্যুয়েন্স ছিল—গ্রামের এক নব্য ধনী, অশিক্ষিত, সে নিজের দাপট দেখাতে গিয়ে একটা পুরো বাউরিপাড়াতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ পাড়াটা পুড়ে খাক হয়ে যায়৷ বাউরিপাড়া ইনডোরে করা সম্ভব নয়, অথচ আউটডোরে আগুনের দৃশ্য কোথায় করব? অনেক চেষ্টার পরে খোঁজ পাওয়া গেল, কাঁকসার জঙ্গলের গভীরে একটা গ্রাম ছিল সাঁওতালদের৷ সেটা তারা পরিত্যাগ করেছে, কেননা তখন নকশালদের প্রচুর প্রভাব ওইদিকে৷ ওরা ভয় পেয়ে চলে গেছে এবং অন্য জায়গায় গ্রাম বসিয়েছে৷ ওই গ্রামটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে৷ আমরা খুঁজেখুঁজে কোনোরকমে সেই জায়গাটায় পৌঁছলাম৷ চারদিকে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে গ্রাম৷ জায়গাটা সবাই বলে বিপজ্জনক, তার কারণ দুপুর তিনটের পর থেকে সেদিকের পিচরাস্তায় আর কোনো লোকজন থাকে না৷ আমাদের পিচরাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের একটা মাটির পথ ধরে আরও অনেকটা গিয়ে গ্রামটাতে পৌঁছতে হত৷ সেখানে গিয়ে দেখা গেল সত্যি সত্যি গ্রামটা আছে কিন্তু তার অনেক পাঁচিল ধসে পড়েছে, অনেক চালা ধসে পড়েছে৷ আর্ট-ডিরেক্টর বললেন, সেটাই আদর্শ জায়গা৷ আমরা যদি এই দেওয়ালগুলো একটু তৈরি করে নিতে পারি, চালাগুলোকে বসিয়ে নিতে পারি, তাহলে এখানে যদি আগুন লাগাই তো কারও কিছু বলবার থাকতে পারে না, কারণ তার আশপাশে কোনো লোকবসতি নেই৷ আমরা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহ করে নিয়ে গ্রামটাকে আবার নতুন করে তৈরি করার কাজ শুরু করলাম৷ আমাদের আর্ট-ডিরেক্টর বললেন,—আপনাদের ক্যাম্প থেকে এসে এসে এটাকে তৈরি করতে গেলে অনেক সময়ও যাবে, তাতে অনেক ঝামেলাও বাড়বে, আমরা এখানেই দুটো তাঁবু খাঁটিয়ে আমি আর আমার লোকজন থেকে যাব, এখানে কাজ করব, আপনারা আপনাদের শুটিং করুন; শুধু যেহেতু আমরা যেতে পারব না তাই আমাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থাটা একটু করে দেবেন, রান্না আমরাই করে নেব৷ তাই সারাদিনের শুটিংয়ের পরে প্রতিদিন আমি আর আমার প্রোডাকশন- ম্যানেজার একটা ভ্যানে করে মাছ কাঁচা আনাজ এইসব নিয়ে সেখানে যেতাম৷ পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যেত, তবু কোনোরকমে ওখানে গিয়ে সেসব ওদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতাম৷ একদিন আমরা শুটিংয়ের পরে সেরকমই বেরোচ্ছি, সৌমিত্র এসে বলল, কোথায় যাচ্ছেন এখন সন্ধের পরে? আমি বললাম, এই একটু ঘুরে আসছি৷ সৌমিত্র একটু অবাক হল, বলল, এত রাতে ঘুরতে যাচ্ছেন, সবাই যে বলছে জায়গাটা ঠিক নেই? তখন ওকে বলতে হল আমাদের ইউনিটের লোকজন ওখানে কাজ করছে, ওরা অপেক্ষা করছে, ওদের খাবারের জিনিসপত্র ওখানে পৌঁছে দিতে হবে৷ সৌমিত্র বলল, আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে৷ আমি বললাম, আপনি না গেলেই পারেন, কেননা জায়গাটা তো শুনছি ভালো নয়৷ সৌমিত্র কিছুতেই শুনল না, বলল, ওরা যদি বিপদ ঘাড়ে নিয়ে কাজ করতে পারে, আমি যেতে পারব না? আপনিও তো যাচ্ছেন! সত্যিসত্যিই জোর করে ও গাড়িতে উঠল, আমাদের সঙ্গে চলল৷ সেখানে পৌঁছে অন্ধকারে প্রথমে তো ওই জায়গাটাই চেনা যায় না, আমরা ডাকাডাকি করছি টর্চ জ্বেলে৷ অনেকক্ষণ পরে ওরা এল, আমাদের পথ দেখিয়ে ওদের তাঁবুতে নিয়ে গেল৷ সবাই সৌমিত্রকে দেখে এত খুশি হয়ে গেল যে একটা আনন্দের পরিবেশ৷ সৌমিত্র বলল, একটু চা বানান, চা খাব সবাই মিলে৷ চা বানানো হল, সৌমিত্র একটা-দুটো গান গাইল৷ ওর গানের গলাটা ভালোই ছিল৷ আমরা মহা আনন্দে সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, তারপর ফিরে এলাম৷
এই যে অ্যাটিচিউড, নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা শুধু না, ইউনিটের অন্য সবার প্রতি যে সহমর্মিতা, এটা সৌমিত্রর একটা অসাধারণ গুণ৷ এইরকম আরও অনেক গুণ আছে, যার জন্যে সৌমিত্র আমার চোখে আলাদা৷